নীল আকাশে তুলোর মতো সাদা মেঘ। পটে আঁকা কোনো ছবি যেন! খাল পাড়ে কাশবন। বাতাসে
সাদা কাশফুলগুলো বারবার হেলে পড়ছে। এমন দৃশ্যে বাবলী কড়ার মনে দোলা লাগে।
শুরু হয়েছে কারমা উৎসব। ভাই আসবে বোনকে বাবার বাড়ি নাইওর নিতে। সে আনন্দে
বাবলীর মনে আদিবাসী গানের সুর বাজে- ‘কাশি ফুলা ফুটেই গেলে/আসা মরা লাগি
গেলে/ভাইয়া বাপা লেগেল আতে বেটিক/কারমা পূজাকে রাতে….।
বাবলী কড়ার বাবার বাড়ি ঝিনাইকুড়িতে। দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম এটি।
প্রতি ভাদ্রে পূর্ণিমার চাঁদে এখানেই কড়ারা ‘কারমা’ উৎসবের আয়োজন চলে।
আশপাশের ওঁরাও, তুরি, সাঁওতাল, মুণ্ডা, পাহান, ভুনজার ও মাহালিরাও এতে অংশ
নেয়। কারমা উৎসবে বিরল প্রজাতির ‘খিল কদম’ গাছের ডাল কেটে এনে বিশেষ আচারের
সঙ্গে পূজা করে আদিবাসীরা। এ গাছটি তাদের কাছে অতি পবিত্র। এ উৎসবে তারা
অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্য লাভের আকুতি জানায় কারাম গোসাঁইয়ের কাছে।
সূর্যটা ডুবুডুবু। আমরাও পা রাখি গ্রামটিতে। সব বাড়ির আঙিনা পরিপাটি করে
সাজানো। উনুনে তেলের পিঠা ভাজার শোঁ শোঁ শব্দ। কড়াদের গোত্র প্রধান বা
মাহাতো জগেন কড়া। তাঁর মতে, তেলের পিঠা ছাড়া কারমা উৎসব হয় না।
এ উৎসবে মাহাতো আগে থেকেই অবিবাহিত কোনো যুবককে খিল কদমের ডাল কেটে আনা ও
বিসর্জনের জন্য মনোনীত করে দেন। এবার এর দায়িত্ব পেয়েছে নবম শ্রেণিপড়ুয়া
বুজন কড়া। শালবনের গহিন থেকে এ গাছের ডাল কেটে আনার রয়েছে বিশেষ নিয়ম। কী
সেই নিয়ম?
গোসল সেরে প্রথমে পবিত্র হতে হয়। গাছের গোড়ার মাটি লেপে পাটকাঠি জ্বালিয়ে,
ধূপ দিয়ে, তিনটি সিঁদুর ফোঁটা মাটি ও গাছে লাগিয়ে ভক্তি করা হয়। এরপর গাছের
সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় দুটি তেলের পিঠা। মনে মনে বলতে হয়, ‘কারাম গোসাঁই আজ
আমরা তোমাকে নিতে এসেছি, তোমার পূজা দেব বলে।’ অতঃপর ‘বিসক্রম’ বলে তিন
কোপে কেটে নেওয়া হয় খিল কদম গাছের বড় একটি ডাল। সেটি মাটিতে পড়ার আগেই ঘাড়ে
করে নিয়ে আসা হয় পূজাস্থলে।
পূজাস্থলে আগেই বাঁশ দিয়ে মাড়োয়া তৈরি করে রাখা হয়। শাপলা ফুল দিয়ে সাজানো
হয় মাড়োয়াটি। অতঃপর ঢাকঢোল বাজিয়ে ডালটিকে বরণ করে মাড়োয়ার চারপাশে আড়াই
পাক ঘুরিয়ে তা মাটিতে গেড়ে দেওয়া হয়।
সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা। দুটি লাল মুরগা (মোরগ) বলি
দিয়ে শুভ সূচনা করা হয় কারমা উৎসবের। রাতভর চলে নাচ, গান আর হাঁড়িয়া খাওয়া।
ভোরবেলা মাহাতো স্নান সেরে প্রথমে এক বাটি দুধ ঢেলে দেয় খিল কদম গাছের
ডালের মাথায়। এর পরপরই অন্যরা একে একে দুধ ঢালতে থাকে। অতঃপর যে যুবকটি ডাল
কেটেছিল, সে প্রথমে ডালটির চারদিকে তিন পাক ঘুরে ডালটিকে কাঁধে তুলে
ঢাকঢোলের তালে তালে সেটিকে বিসর্জন দেয় নিকটবর্তী নদী বা পুকুরে। কড়াসহ
অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের বিশ্বাস, এ পূজার মাধ্যমেই তাদের অভাবমুক্তি ও
সৌভাগ্য লাভ ঘটে।
এ কারণেই উৎসবের পাঁচ দিন আগে থেকে এরা ধর্মের পরীক্ষা শুরু করে। দুটি
বাঁশের ডালার মধ্যে কালাই বীজ রেখে বালু ও মাটি দিয়ে তারা তা ঢেকে দেয়।
সেদিন থেকেই শুরু হয় উপোস। এ সময়ে খেতে হয় শুধুই নিরামিষ। যে কয়জন উপোস
থাকে, সে কয়টি ছোট কাঠি পুঁতে দেওয়া হয় ডালায়। উপোসকারী অবিবাহিত হলে কাঠির
গায়ে কাজল আর বিবাহিত হলে সিঁদুর লাগানো হয়। তাদের বিশ্বাস উপোস অবস্থায়
ধর্মমতে না চললে ডালায় তাদের হাতে লাগানো বীজ থেকে কোনো চারা গজাবে না।
উৎসবের দিন নতুন চারা গজানো ডালা দুটিকে রাখা হয় খিল কদম ডালের সঙ্গেই।
কারমা উৎসবের মোরগ বলি পর্বের পরই শুরু হয় উৎসবের পেছনের পৌরাণিক কাহিনী
বলার আসর। মূলত এর ফলেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সহজেই ছড়িয়ে পড়েছে কারমা
উৎসবের বিশ্বাসটি। কাহিনী বলার পর্বে কারাম ডালটিকে ঘিরে বসে আদিবাসী
নারীরা। সেজেগুজে ঘুমটা টেনে বসে তারা। সামনে কাঁসার পেয়ালায় রাখা হয়
প্রদীপ, তেলের পিঠা, ছোলা, দূর্বাঘাস ও জুঁই ফুল। গোত্র প্রধান বা মাহাতো
বলতে থাকেন উৎসবের পৌরাণিক কাহিনীটি। মাঝেমধ্যে তিনি উচ্চস্বরে বলেন, ‘ফুল
ফেকিয়ে।’ ঠিক তখন সবাই একমুঠো জুঁই ফুল বা ঘাস ছুড়ে দেয় ডালটির দিকে।
কাহিনী শেষে মনের নানা ইচ্ছা নিয়ে সবাই তাদের বানানো তেলের পিঠা বেঁধে দেয়
কারাম ডালটির সঙ্গে। জগেন কড়ার মুখে শোনা কারমা উৎসবের কাহিনীটি কারাম
আর ধারাম দুই ভাই। কারাম বড়। ধারাম ছোট। পারাবেতী তাদের একমাত্র বোন।
ভাদ্র মাসে একবার গ্রামের এক ধনী ব্যক্তি ঢোল পিটিয়ে তার জমিতে হাউলির (ধান
গাড়ার) ডাক দেয়। অন্যদের সঙ্গে কারাম-ধারামও যায় সেখানে। কাজ শুরু হয় খুব
ভোরে। কিছু চারা লাগানোর পরই সকালের নাশতা বা পান্তার ডাক পড়ে। দুই ভাই তখন
কলাপাতা বিছিয়ে বসে যায় লাইনে; কিন্তু তাদের কাছে এসেই তা শেষ হয়ে যায়।
পান্তা না পেয়ে বড়ই দুঃখ পায় তারা। নিজেকে সামলে নিয়ে দুপুরে খাবারের আশায়
তারা আবার কাজে ফেরে; কিন্তু এবারও ঘটে একই ঘটনা। তাদের কাছাকাছি এসেই
খাবার শেষ! ব্যথিত হয় দুই ভাই-ই। রাগে-কষ্টে তারা তাদের হাতে লাগানো রোয়া
তুলে ফেলতে রওনা দেয়।
পথেই ছিল একটি বটগাছ। দুঃখের কারণ জানতে চাইলে দুইভাই বটগাছকে সব খুলে বলে।
সব শুনে বটগাছ বলে- ‘তোদের কারমা কপাল জের গেলে’(তোদের কর্মভাগ্য পুড়ে
গেছে)। সাত সমুদ্র লংকা পাড় হয়ে আনতে হবে কর্মভাগ্যকে।
বটগাছের কথা মতো কারমা-ধারমা রওনা হয় কর্মভাগ্য ফিরিয়ে আনতে।
পথে তাদের সঙ্গে দেখা একটি কুলগাছের। কারাম-ধারামের কথা শুনে সেও জানায় তার
দুঃখের কথাটি। তার ফল পেকে মাটিতে পড়ে থাকে কিন্তু কেউ সে ফল খায় না। তার
ভাগ্যটিও জেনে আসতে দুই ভাইকে অনুরোধ করে। যেতে যেতে কারাম-ধারামের দেখা হয়
একটি ডুমুরগাছের সঙ্গে। তাদের লংকা পার হওয়ার কথা শুনে সে আফসোস করে বলে,
‘আমার এমন সুদৃশ্য ফল পেকে থাকে কিন্তু মানুষ ও পাখি সে দিকে ফিরেও তাকায়
না।’ তাদের সে অনুরোধ করে তার ভাগ্যটিও জেনে আসার। কিছুদূর যেতেই কারাম আর
ধারামের সামনে পড়ে একটি নদী। নদীর তীরে দুটি হাতি নিজেদের মধ্যে মারামারি
করছিল। তাদের পুরো শরীর কাদায় ঢাকা। কারাম-ধারামের কথা শুনে তারা দুঃখ করে
বলে, ‘আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে আর কত কাল কাদায় ঢাকা থাকব? আমাদের
কি কেউ গোসল করিয়ে পরিষ্কার করে রাখবে না?’ তোমরা আমাদের ভাগ্যটিও জেনে
এসো।
নদী পার হয়ে কিছুদূর যেতেই পড়ে লংকা সমুদ্র; কিন্তু বিশাল এ সমুদ্র কারাম-ধারাম কিভাবে পার হবে?<br />
সমুদ্রে ছিল বড় একটি কুমির। সাত দিন আগে তার গলায় বিঁধেছে আড় মাছের কাঁটা।
যন্ত্রণায় তার ঘুম হারাম। সে কারাম-ধারামের সাহায্য চাইল। সমুদ্র পার করা ও
নিয়ে আসার শর্তে দুই ভাই কুমিরের গলার কাঁটা বের করে দিল। অতঃপর কুমিরের
পিঠে চড়ে লংকা সমুদ্র পার হতেই তারা দেখা পায় তাদের কর্মভাগ্যের। সারা শরীর
তার পোকায় খাচ্ছিল। কারাম-ধারাম স্পর্শ করতেই সেটি গাছ হয়ে গেল। দুই
ভাইয়ের মনে তখন অন্য রকম শক্তির সঞ্চার হলো। তারা সেই গাছ ঘাড়ে নিয়ে আবার
বাড়ির দিকে রওনা দিল।
ফেরার পথে হাতি দুটো তাদের ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে, কারাম-ধারাম বলে, ‘এমন
একজন লাগবে যে তোমাদের শরীর পরিষ্কার করে দেবে।’ হাতি দুটি মিনতি করে
তাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। দুই ভাই তখন দুই হাতির পিঠে চড়ে বসে। এরপর
ডুমুরগাছ তার ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে তারা বলে, ‘তোমার গোড়ার মাটির নিচে
সাত কলস ধন আছে। সেটি সরালেই তোমার ফল সবাই খাবে।
এভাবে দুই ভাই কর্মভাগ্য নিয়ে আসে ওই বটগাছটির কাছে। বটগাছ কর্মভাগ্যরূপী
ওই গাছটিকে মাটিতে গেড়ে তাদের বোন পারাবেতীকে দিয়ে পূজা করার নির্দেশ দেয়।
তারা তাই করে। কড়াদের বিশ্বাস, সে সময় থেকেই পৃথিবীতে কারমা উৎসব পালন হয়ে
আসছে।
কড়াসহ এ অঞ্চলের আদিবাসীরা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করছে। কিন্তু
তবুও প্রতি ভাদ্রে তারা ধুমধামের সঙ্গে পালন করে কারমা উৎসবটি। তাদের
বিশ্বাস, কারাম গোসাঁই একদিন ঠিক ঠিক তাদের ঘরে আসবেন। দুঃখে ভরা জীবনে তখন
লাগবে আনন্দের সুবাতাস। সে বিশ্বাসেই এ সময় কড়ারা গান গায়, ‘সব গাতনি
পিন্দ লাল/নতুন নতুন সুপ দিয়া/নতুন পারবেতী/আজো কারমাকে রাতি…।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকন্ঠের "শিলালিপি"তে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪
সাদা কাশফুলগুলো বারবার হেলে পড়ছে। এমন দৃশ্যে বাবলী কড়ার মনে দোলা লাগে।
শুরু হয়েছে কারমা উৎসব। ভাই আসবে বোনকে বাবার বাড়ি নাইওর নিতে। সে আনন্দে
বাবলীর মনে আদিবাসী গানের সুর বাজে- ‘কাশি ফুলা ফুটেই গেলে/আসা মরা লাগি
গেলে/ভাইয়া বাপা লেগেল আতে বেটিক/কারমা পূজাকে রাতে….।
বাবলী কড়ার বাবার বাড়ি ঝিনাইকুড়িতে। দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম এটি।
প্রতি ভাদ্রে পূর্ণিমার চাঁদে এখানেই কড়ারা ‘কারমা’ উৎসবের আয়োজন চলে।
আশপাশের ওঁরাও, তুরি, সাঁওতাল, মুণ্ডা, পাহান, ভুনজার ও মাহালিরাও এতে অংশ
নেয়। কারমা উৎসবে বিরল প্রজাতির ‘খিল কদম’ গাছের ডাল কেটে এনে বিশেষ আচারের
সঙ্গে পূজা করে আদিবাসীরা। এ গাছটি তাদের কাছে অতি পবিত্র। এ উৎসবে তারা
অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্য লাভের আকুতি জানায় কারাম গোসাঁইয়ের কাছে।
সূর্যটা ডুবুডুবু। আমরাও পা রাখি গ্রামটিতে। সব বাড়ির আঙিনা পরিপাটি করে
সাজানো। উনুনে তেলের পিঠা ভাজার শোঁ শোঁ শব্দ। কড়াদের গোত্র প্রধান বা
মাহাতো জগেন কড়া। তাঁর মতে, তেলের পিঠা ছাড়া কারমা উৎসব হয় না।
এ উৎসবে মাহাতো আগে থেকেই অবিবাহিত কোনো যুবককে খিল কদমের ডাল কেটে আনা ও
বিসর্জনের জন্য মনোনীত করে দেন। এবার এর দায়িত্ব পেয়েছে নবম শ্রেণিপড়ুয়া
বুজন কড়া। শালবনের গহিন থেকে এ গাছের ডাল কেটে আনার রয়েছে বিশেষ নিয়ম। কী
সেই নিয়ম?
গোসল সেরে প্রথমে পবিত্র হতে হয়। গাছের গোড়ার মাটি লেপে পাটকাঠি জ্বালিয়ে,
ধূপ দিয়ে, তিনটি সিঁদুর ফোঁটা মাটি ও গাছে লাগিয়ে ভক্তি করা হয়। এরপর গাছের
সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় দুটি তেলের পিঠা। মনে মনে বলতে হয়, ‘কারাম গোসাঁই আজ
আমরা তোমাকে নিতে এসেছি, তোমার পূজা দেব বলে।’ অতঃপর ‘বিসক্রম’ বলে তিন
কোপে কেটে নেওয়া হয় খিল কদম গাছের বড় একটি ডাল। সেটি মাটিতে পড়ার আগেই ঘাড়ে
করে নিয়ে আসা হয় পূজাস্থলে।
পূজাস্থলে আগেই বাঁশ দিয়ে মাড়োয়া তৈরি করে রাখা হয়। শাপলা ফুল দিয়ে সাজানো
হয় মাড়োয়াটি। অতঃপর ঢাকঢোল বাজিয়ে ডালটিকে বরণ করে মাড়োয়ার চারপাশে আড়াই
পাক ঘুরিয়ে তা মাটিতে গেড়ে দেওয়া হয়।
সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা। দুটি লাল মুরগা (মোরগ) বলি
দিয়ে শুভ সূচনা করা হয় কারমা উৎসবের। রাতভর চলে নাচ, গান আর হাঁড়িয়া খাওয়া।
ভোরবেলা মাহাতো স্নান সেরে প্রথমে এক বাটি দুধ ঢেলে দেয় খিল কদম গাছের
ডালের মাথায়। এর পরপরই অন্যরা একে একে দুধ ঢালতে থাকে। অতঃপর যে যুবকটি ডাল
কেটেছিল, সে প্রথমে ডালটির চারদিকে তিন পাক ঘুরে ডালটিকে কাঁধে তুলে
ঢাকঢোলের তালে তালে সেটিকে বিসর্জন দেয় নিকটবর্তী নদী বা পুকুরে। কড়াসহ
অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের বিশ্বাস, এ পূজার মাধ্যমেই তাদের অভাবমুক্তি ও
সৌভাগ্য লাভ ঘটে।
এ কারণেই উৎসবের পাঁচ দিন আগে থেকে এরা ধর্মের পরীক্ষা শুরু করে। দুটি
বাঁশের ডালার মধ্যে কালাই বীজ রেখে বালু ও মাটি দিয়ে তারা তা ঢেকে দেয়।
সেদিন থেকেই শুরু হয় উপোস। এ সময়ে খেতে হয় শুধুই নিরামিষ। যে কয়জন উপোস
থাকে, সে কয়টি ছোট কাঠি পুঁতে দেওয়া হয় ডালায়। উপোসকারী অবিবাহিত হলে কাঠির
গায়ে কাজল আর বিবাহিত হলে সিঁদুর লাগানো হয়। তাদের বিশ্বাস উপোস অবস্থায়
ধর্মমতে না চললে ডালায় তাদের হাতে লাগানো বীজ থেকে কোনো চারা গজাবে না।
উৎসবের দিন নতুন চারা গজানো ডালা দুটিকে রাখা হয় খিল কদম ডালের সঙ্গেই।
কারমা উৎসবের মোরগ বলি পর্বের পরই শুরু হয় উৎসবের পেছনের পৌরাণিক কাহিনী
বলার আসর। মূলত এর ফলেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সহজেই ছড়িয়ে পড়েছে কারমা
উৎসবের বিশ্বাসটি। কাহিনী বলার পর্বে কারাম ডালটিকে ঘিরে বসে আদিবাসী
নারীরা। সেজেগুজে ঘুমটা টেনে বসে তারা। সামনে কাঁসার পেয়ালায় রাখা হয়
প্রদীপ, তেলের পিঠা, ছোলা, দূর্বাঘাস ও জুঁই ফুল। গোত্র প্রধান বা মাহাতো
বলতে থাকেন উৎসবের পৌরাণিক কাহিনীটি। মাঝেমধ্যে তিনি উচ্চস্বরে বলেন, ‘ফুল
ফেকিয়ে।’ ঠিক তখন সবাই একমুঠো জুঁই ফুল বা ঘাস ছুড়ে দেয় ডালটির দিকে।
কাহিনী শেষে মনের নানা ইচ্ছা নিয়ে সবাই তাদের বানানো তেলের পিঠা বেঁধে দেয়
কারাম ডালটির সঙ্গে। জগেন কড়ার মুখে শোনা কারমা উৎসবের কাহিনীটি কারাম
আর ধারাম দুই ভাই। কারাম বড়। ধারাম ছোট। পারাবেতী তাদের একমাত্র বোন।
ভাদ্র মাসে একবার গ্রামের এক ধনী ব্যক্তি ঢোল পিটিয়ে তার জমিতে হাউলির (ধান
গাড়ার) ডাক দেয়। অন্যদের সঙ্গে কারাম-ধারামও যায় সেখানে। কাজ শুরু হয় খুব
ভোরে। কিছু চারা লাগানোর পরই সকালের নাশতা বা পান্তার ডাক পড়ে। দুই ভাই তখন
কলাপাতা বিছিয়ে বসে যায় লাইনে; কিন্তু তাদের কাছে এসেই তা শেষ হয়ে যায়।
পান্তা না পেয়ে বড়ই দুঃখ পায় তারা। নিজেকে সামলে নিয়ে দুপুরে খাবারের আশায়
তারা আবার কাজে ফেরে; কিন্তু এবারও ঘটে একই ঘটনা। তাদের কাছাকাছি এসেই
খাবার শেষ! ব্যথিত হয় দুই ভাই-ই। রাগে-কষ্টে তারা তাদের হাতে লাগানো রোয়া
তুলে ফেলতে রওনা দেয়।
পথেই ছিল একটি বটগাছ। দুঃখের কারণ জানতে চাইলে দুইভাই বটগাছকে সব খুলে বলে।
সব শুনে বটগাছ বলে- ‘তোদের কারমা কপাল জের গেলে’(তোদের কর্মভাগ্য পুড়ে
গেছে)। সাত সমুদ্র লংকা পাড় হয়ে আনতে হবে কর্মভাগ্যকে।
বটগাছের কথা মতো কারমা-ধারমা রওনা হয় কর্মভাগ্য ফিরিয়ে আনতে।
পথে তাদের সঙ্গে দেখা একটি কুলগাছের। কারাম-ধারামের কথা শুনে সেও জানায় তার
দুঃখের কথাটি। তার ফল পেকে মাটিতে পড়ে থাকে কিন্তু কেউ সে ফল খায় না। তার
ভাগ্যটিও জেনে আসতে দুই ভাইকে অনুরোধ করে। যেতে যেতে কারাম-ধারামের দেখা হয়
একটি ডুমুরগাছের সঙ্গে। তাদের লংকা পার হওয়ার কথা শুনে সে আফসোস করে বলে,
‘আমার এমন সুদৃশ্য ফল পেকে থাকে কিন্তু মানুষ ও পাখি সে দিকে ফিরেও তাকায়
না।’ তাদের সে অনুরোধ করে তার ভাগ্যটিও জেনে আসার। কিছুদূর যেতেই কারাম আর
ধারামের সামনে পড়ে একটি নদী। নদীর তীরে দুটি হাতি নিজেদের মধ্যে মারামারি
করছিল। তাদের পুরো শরীর কাদায় ঢাকা। কারাম-ধারামের কথা শুনে তারা দুঃখ করে
বলে, ‘আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে আর কত কাল কাদায় ঢাকা থাকব? আমাদের
কি কেউ গোসল করিয়ে পরিষ্কার করে রাখবে না?’ তোমরা আমাদের ভাগ্যটিও জেনে
এসো।
নদী পার হয়ে কিছুদূর যেতেই পড়ে লংকা সমুদ্র; কিন্তু বিশাল এ সমুদ্র কারাম-ধারাম কিভাবে পার হবে?<br />
সমুদ্রে ছিল বড় একটি কুমির। সাত দিন আগে তার গলায় বিঁধেছে আড় মাছের কাঁটা।
যন্ত্রণায় তার ঘুম হারাম। সে কারাম-ধারামের সাহায্য চাইল। সমুদ্র পার করা ও
নিয়ে আসার শর্তে দুই ভাই কুমিরের গলার কাঁটা বের করে দিল। অতঃপর কুমিরের
পিঠে চড়ে লংকা সমুদ্র পার হতেই তারা দেখা পায় তাদের কর্মভাগ্যের। সারা শরীর
তার পোকায় খাচ্ছিল। কারাম-ধারাম স্পর্শ করতেই সেটি গাছ হয়ে গেল। দুই
ভাইয়ের মনে তখন অন্য রকম শক্তির সঞ্চার হলো। তারা সেই গাছ ঘাড়ে নিয়ে আবার
বাড়ির দিকে রওনা দিল।
ফেরার পথে হাতি দুটো তাদের ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে, কারাম-ধারাম বলে, ‘এমন
একজন লাগবে যে তোমাদের শরীর পরিষ্কার করে দেবে।’ হাতি দুটি মিনতি করে
তাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। দুই ভাই তখন দুই হাতির পিঠে চড়ে বসে। এরপর
ডুমুরগাছ তার ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে তারা বলে, ‘তোমার গোড়ার মাটির নিচে
সাত কলস ধন আছে। সেটি সরালেই তোমার ফল সবাই খাবে।
এভাবে দুই ভাই কর্মভাগ্য নিয়ে আসে ওই বটগাছটির কাছে। বটগাছ কর্মভাগ্যরূপী
ওই গাছটিকে মাটিতে গেড়ে তাদের বোন পারাবেতীকে দিয়ে পূজা করার নির্দেশ দেয়।
তারা তাই করে। কড়াদের বিশ্বাস, সে সময় থেকেই পৃথিবীতে কারমা উৎসব পালন হয়ে
আসছে।
কড়াসহ এ অঞ্চলের আদিবাসীরা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করছে। কিন্তু
তবুও প্রতি ভাদ্রে তারা ধুমধামের সঙ্গে পালন করে কারমা উৎসবটি। তাদের
বিশ্বাস, কারাম গোসাঁই একদিন ঠিক ঠিক তাদের ঘরে আসবেন। দুঃখে ভরা জীবনে তখন
লাগবে আনন্দের সুবাতাস। সে বিশ্বাসেই এ সময় কড়ারা গান গায়, ‘সব গাতনি
পিন্দ লাল/নতুন নতুন সুপ দিয়া/নতুন পারবেতী/আজো কারমাকে রাতি…।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকন্ঠের "শিলালিপি"তে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪
0 Comment " কারমা উৎসবে কারাম-ধারাম কাহিনী "
Post a Comment