ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামে আদিবাসী নরেন সরদার

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার গুলাই গ্রাম নিবাসী আদিবাসী কৃষক নরেন সর্দার প্রায় ১৯
বিঘা জমির মালিক। তার মালিকানাধীন জমির পক্ষে সব ধরনের দলিল রয়েছে। হাল
নাগাদ খাজনা-খারিজ পরিশোধিত আছে। তবুও তার দখলে নাই সিংহভাগ জমি। দলিল আছে,
 জমি নাই। দলিল তার হাতে, জমি ভূমিদস্যুদের হাতে। ভূমিদস্যুদের অত্যাচার
নির্যাতনে আপন ভূমি ছেড়ে দিয়ে তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে সরকারি খাস জমিতে।
তবুও তিনি ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তরভাবে।
নরেন
 তার জমিতে যখনি যাওয়ার চেষ্টা করেছেন তখনি হামলা হয়েছে তার ওপর। তাকে বেদম
 মারধর করে আপন ভূমি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তার ওপর সর্বশেষ হামলা হয় ২৪
জুন ২০১৫ ইং তারিখে। এই হামলার সংবাদ পরদিন ২৫ জুন রাজশাহীর দৈনিকগুলোতে
প্রকাশিত হয়। এরপর সেটা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয় সেড এর পক্ষ হতে।
দেওপাড়া ইউনিয়নের গুলাইগ্রামে আরএস ১২৯২ ও ১২৯৩ দাগে নরেন সরদারের তিন বিঘা জমি
আছে। এই জমিকে তিনি আম বাগানে পরিণত করেছেন। ১৯টি আম গাছ লাগিয়েছেন। এই
জমিতেই তার বাবা সুপন ওরফে সুপল সরদার পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন।
কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪-৫ বছরের মাথায় ভূমিদস্যুদের অত্যাচার
নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। তিনি ভারতে গেলেও ছেলে
নরেন থেকে যায় দেশের মাটিতে। এরপর পৈতৃক সম্পত্তি রক্ষা করতে গিয়ে তাকেও
নানাবিধ অত্যাচারের শিকার হতে হয়। সেই অত্যাচার আজও বন্ধ হয়নি। দলিল থাকা
সত্ত্বেও নরেন এখন ভূমি ছাড়া। পরিবার পরিজন নিয়ে একটি সরকারি পুকুরের
কিনারে কোন রকমে ঝুপরি ঘরের মতো তৈরি করে বসবাস করছেন।
গুলাই গ্রামের
 জমিটিতে সমস্যা তৈরি করা হয় ১৯৭৯ সালে। গুলাই এর নিকটবর্তী ধামিনা গ্রাম
নিবাসী আবদুল মজিদ ও আশরাফুল নামের দুই ভাই দাবি করেন যে, তারা ঐ জমি মৃত
মারকুস বিশ্বাসের পুত্র স্টিফান বিশ্বাস ও আন্দ্রিয়াস বিশ্বাসের কাছ থেকে
কিনে নিয়েছেন এবং সেটা ছেড়ে দেয়ার জন্য নরেনকে নির্দেশ দেন।
কিন্তু
নরেন জানেন যে, তার জমি নিয়ে ভূমিদস্যুদের ষড়যন্ত্রের জাল তার বাবার আমল
থেকেই বিছানো শুরু হয়েছে। তাই  জমি ছেড়ে কখনোই চলে যাননি। জমি থেকে সরাতে
না পারলেও ষড়যন্ত্র তাতে বন্ধ থাকেনি। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই মজিদ ও আশরাফ
 কর্তৃক ১৯৯১ সালে পার্শ্ববর্তী দাশপুকুর নিবাসী জনৈক তোফাজ্জল হোসেনের
পুত্র নুরুল হক আওয়ালের কাছে জমিটিকে বিক্রি করা হয়েছে মর্মে নতুন দলিল
তৈরি করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময় নরেনকে উচ্ছেদের চেষ্টা চলে। ২০০৩ সালে
নুরুল হক আওয়াল সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে ঘর-বাড়ি ভেঙে দিয়ে নরেনকে
সমুলে সেখান থেকে উচ্ছেদ করেন। এরপর নরেনের আশ্রয় হয় সরকারি খাস জমিতে।
তাকে কাটাতে হয় উদ্বাস্তু জীবন।
যেহেতু নরেনের দলিল আছে তাই তার পাশে
 এসে দাঁড়ায় অনেক বাঙালি পরিবার। তারা নরেনকে সহায়তা করার কারণে চলতি বছরের
 মার্চ-এপ্রিলে নরেন আবারও তার জমিতে ঘর তোলেন এবং বসবাস করতে থাকেন।
কিন্তু ২৪ জুন নুরুল হক আওয়াল কার, মাইক্রো, ট্রাক সহকারে গু-া-পা-া নিয়ে
এসে নরেনের ঘর-বাড়ি আবারও ভেঙে দিয়ে সবকিছু ট্রাকযোগে নিয়ে যায়। ফলে নরেনকে
 আবারও খাসপুকুরপাড়ে গিয়ে গাছের তলায় আশ্রয় নিতে হয়েছে।
জমির
দলিলপত্রে  (তিয়ান নং ৫১৭, জেএল নং ৩১৭, রে: সার্ভে নং ৮৭, মৌজা গুলাই)
দেখা যায় যে, জমির প্রধান মালিক ছিলেন কাঙালি সরদার। তার ৪ পুত্র সুপল
সরদার, শ্রীমন্ত সরদার, সর্বেশ্বর সরদার ও জিঠু সরদার। সর্বেশ্বর সরদার
নিঃসন্তান অবস্থায় ও জিঠু সরদার অবিবাহিত অবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার
আগেই মারা যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পিতা কাঙালি সরদার মারা যায়
ভারতে। ফলে জমির মালিকানা চলে আসে শ্রীমন্ত সরদার ও সুপল সরদারের হাতে।
শ্রীমন্ত সরদার তার অংশের জমি সুপলকে দেন এবং তিনিও মারা যান।

কাঙালি সরদার হলেন আদিবাসী ওঁড়াও সম্প্রদায়ের লোক। আর ভূমি নিয়ে আদিবাসীদের কি
ভয়ংকর পরিস্থিতি পার করতে হয় তা অজানা নয় কারো। তেমন পরিস্থিতির শিকার হয়ে
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে তাকে। তার সন্তান সুপন অথবা সুপলকেও
 একই পরিস্থিতি অতিক্রম করতে হচ্ছে। নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কঠিন
পরিস্থিতির মধ্যে মোকাবিলা করতে হচ্ছে ভূমিদস্যুদের।
সুপলের জমি মজিদ
 ও আশরাফ কিনেছে মারকুস বিশ্বাসের পুত্র স্টিফান বিশ্বাস ও আন্দ্রিয়াস
বিশ্বাসের কাছ থেকে। অথচ ঐ জমিতে স্টিফান, আন্দ্রিয়াস এর কোন অংশীদারিত্ব
নাই। কিন্তু ভূমি তাদের আদিবাসী পরিচিতি আড়াল করে কখনো খ্রিস্টান, কখনো
মুসলমান কাগজে, দলিলে, এফিডেভিটে দেখিয়েছে। কখনো তাদেরকে মার্কুশের পুত্র
কখনো সর্বেশ্বর রায়ের পুত্র বলে  উল্লেখ করেছে। আবদুল মজিদ ও আশরাফ আলী যে
দলিলে (দলিল নং ১৫০৫১-১৯৬-২৪৬-২৪৯ তাং-০৭/০৫/৭৯ইং) জমিটি ক্রয় করেছেন, সেই
দলিলে স্টিফান বিশ্বাস ও আন্দ্রিয়াস বিশ্বাসকে খ্রিস্টান বলা হয়েছে এবং
তাদের পিতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে মার্কুশ বিশ্বাস। অথচ এর তিন মাস পর
(২১/০৮/৭৯ ইং তারিখে) রাজশাহী জেলা প্রশাসককে দেয়া এক পত্রে এই মজিদই
উল্লেখিত দুই ব্যক্তির পিতার নাম সর্বেশ্বর সরদার বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া 
একটি এফিডেভিটে (এফিডেভিট তাং ০৯/০৮/৭৯ ইং) উল্লেখিত দুই খ্রিস্টানকে
মুসলমান হিসেবে উল্লেখ করেন তারা। এর থেকে পরিষ্কার যে, ভুয়া দলিল তৈরি করে
 পৈতৃক সূত্রে পাওয়া নরেন সরদারের জমি দখলের চেষ্টা হয়েছে। কাগজে-কলমে সফল
না হতে পেরে তাকে শক্তির জোড়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
তিন বিঘা জমি জবর
দখলের যে কাহিনী, নরেনের অন্য জমিগুলোতেও একই অবস্থা। তার সবগুলো জমির ওপর
ভূমিদস্যুদের লোলুপ দৃষ্টি। সবগুলোতেই জাল দলিল আর মামলা। যেমন নরেন
সরদারের আরেকটি জমি জনৈক বিশু সরদার পিতা পটলী সরদারের কাছ থেকে কেনা হয়েছে
 মর্মে দলিল করেছে ভূমিদস্যুরা। অথচ বিশু সরদার কিংবা পটলী সরদার নামে সুপল
 সরদারের উত্তরাধিকারী কিংবা নরেন সরদারের অংশীদারি কেউ নাই। কিন্তু জাল
দলিল আর অসংখ্য মামলার বেড়াজালে খাবি খাচ্ছেন নরেন। প্রশাসন যেন
ভূমিদস্যুদের পক্ষেই। ভূমিদস্যুরা মামলা করলেই তারা নরেন সরদারের বিরুদ্ধে
উঠে-পড়ে লাগছেন। যখন এই লেখা লিখছি তখনো তার দুই পুত্র  রবি সরদার ও ভিষণ
সরদার ভূমিদস্যুদের মামলায় জেলহাজতে রয়েছে প্রায় দুই মাস ধরে। কিন্তু
আদিবাসী নরেন সরদার যখন মামলা করেন তখন পুলিশ কিংবা প্রশাসনের কোন টনক নড়ে
না। এত মামলা, এত হয়রানি নরেনের একার পক্ষে মোকাবিলা করা অত সহজ নয়। কিন্তু
 কোন উপায়ও তার নাই। যে ভূমি অফিস তার মালিকানার জমিতে ভূমিদস্যুদের পক্ষে
দলিল করে দিচ্ছেন, যে আদালতে তার জমি সংক্রান্ত মামলাগুলো চলছে তারা
জাল-জালিয়াতির বিষয়টি কেন অনুধাবন করছেন না তা বোধগম্য নয়। অথচ ঐ সব,
এফিডেভিট, দরখাস্তের মধ্যেই ভূমি দস্যুদের জালিয়াতি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে
যদি চোখ খুলে সেগুলো পড়া এবং বিবেক দ্বারা বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়।

0 Comment "ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামে আদিবাসী নরেন সরদার"

Post a Comment