আদিবাসীদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর বিচিত্রা তিরকি

বিচিত্রা তিরকি
যেখানেই আদিবাসীদের ওপর অন্যায়-অত্যাচার, জমি জালিয়াতির বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম, সেখানেই সামনের কাতারে সোচ্চার বিচিত্রা তিরকি। পড়ে পড়ে মার খাওয়া আদিবাসীদের সাহস ও উদ্দীপনা জুগিয়ে চলেছেন তিনি। তাঁর ডাকে জড়ো হন শত শত আদিবাসী, যাঁদের অধিকাংশই নারী।
সেই বিচিত্রা তিরকি এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার পার্বতীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সংরক্ষিত নারী সদস্য। পাঁচ বছর বয়সী ছেলে সংগ্রামকে নিয়ে থাকেন ইউনিয়নের জিনারপুর গ্রামে। সমতলে আদিবাসীদের বড় সংগঠন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের জেলা সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সদস্য বিচিত্রা। গ্রামীণ নারী অধিকার রক্ষায় সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সম্মাননা।
শুরুর কথা: ১৯৯৩ সালে বিচিত্রার সঙ্গে বিয়ের সময় মঙ্গলা সরকার ছিলেন দিনমজুর। অথচ পৈতৃক সূত্রে ৪৮ বিঘা জমি পেয়েছিলেন তিনি। দাঙ্গাবাজ জালিয়াত চক্রের লোকজন জাল দলিল করে ওই জমি দখল করে। পরে ওই জাল দলিল বাতিলের মামলা করেন মঙ্গলা সরকার। রায় পাওয়ার আগেই জমির শোকে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যান তিনি। এরপর স্বামীর মৃতদেহ ছুঁয়ে শপথ নেন বিচিত্রা, জালিয়াত চক্রের হাত থেকে জমি উদ্ধারের মরণপণ লড়াই করবেন। বিচিত্রা পরের জমিতে দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি মামলা লড়তে থাকেন। আর তলে তলে গ্রামবাসীকে সংগঠিত করতে থাকেন। যার মধ্যে অধিকাংশই তাঁর মতোই শ্রমজীবী নারী। মামলা লড়তে সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে একটি মানবাধিকার সংগঠন। মামলায় জিততেও থাকেন একের পর এক। কিন্তু জমি দখল নিতে পারেন না।
এরই মধ্যে ২০০৯ সালে নওগাঁর পোরশা উপজেলার খাতিরপুরে একটি আদিবাসী পল্লিতে ভূমি জালিয়াত চক্রের লাঠিয়াল বাহিনীর হামলার প্রতিবাদে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের আন্দোলনে যুক্ত হন বিচিত্রা। একপর্যায়ে পোরশার সরাইগাছি থেকে নওগাঁ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার গণপদযাত্রা কর্মসূচি নেয় জাতীয় আদিবাসী পরিষদ। তখন প্রায় ছয় মাস বয়সী ছেলে সংগ্রামকে কোলে নিয়ে গণপদযাত্রায় অংশ নেন বিচিত্রা। ৩২ কিলোমিটার হাঁটার পর রাস্তার ওপর নওগাঁর মহাদেবপুরে তৃষ্ণার্ত সংগ্রামকে পানি পান করানোর সময় প্রথম আলোর ক্যামেরায় ধরা পড়েন বিচিত্রা। হন সংবাদ শিরোনাম।
গণপদযাত্রায় এসে বিচিত্রা ঘোষণা দেন, এ বৃহত্তর সংগ্রামে অংশ নিয়ে তিনি উদ্দীপ্ত হয়েছেন। বাড়ি ফেরার পর গ্রামের আদিবাসী নারীদের নিয়ে জমি দখল নেবেন। যেই কথা সেই কাজ। গ্রামের নারীদের নিয়ে তিনি প্রভাবশালী জালিয়াত চক্রের জবর দখলে থাকা জমি উদ্ধার করে আবারও প্রথম আলোর সংবাদ শিরোনাম হন।
বিচিত্রা তিরকির এ বিজয়ে আদিবাসীদের মধ্য থেকে জালিয়াত চক্রের জুজুর ভয় দূর হয়ে যায়। বিচিত্রা তিরকিও তাঁদের কাছে হয়ে ওঠেন লড়াকু নেত্রী। এরপর শুরু হয় বিচিত্রার ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া।
তবে বিচিত্রা তিরকি আত্মতৃপ্ত নন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো জালিয়াত চক্র আদিবাসীদের শত শত বিঘা জমি জাল করে দখলে রেখেছে। আদিবাসী নারীরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে বিচার পাচ্ছেন না। আদিবাসীরা হামলাসহ নানা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। দেশ ত্যাগ করছেন। দেশে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা পায় না। আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলন নিয়ে যেতে হবে অনেক পথ। আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলনের পথে হাঁটতে চাই আজীবন।’
বিচিত্রা তিরকি প্রসঙ্গে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, বৃহত্তর রাজশাহীর যেকোনো স্থানে বড় কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হলে বিচিত্রার ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। বিচিত্রার মতো লড়াকু নেত্রী আরও দরকার। তবেই আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সহজ হবে।

0 Comment "আদিবাসীদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর বিচিত্রা তিরকি"

Post a Comment