আদিবাসী উৎসব : সাংগ্রেং ও সাংগ্রাইং

"আদিবাসী উৎসব : সাংগ্রেং ও সাংগ্রাইং ॥ সালেক খোকন আদিবাসীদের উৎসবগুলো সাধারণত বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে থাকে। পুরনো বছরের  সব ক্লান্তি আর পাপ ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে নতুন বছরকে বরণ করতে রাখাইনরা
ধুমধামের সঙ্গে পালন করে সাংগ্রেং উৎসবটি। এটি তাদের অন্যতম মিলন উৎসব।
তারা উৎসবটি পালন করে আসছে আবহমান কাল থেকে।সাংগ্রেং উৎসবটি হয় সাধারণত তিন দিনের। রাখাইনদের নিজস্ব পঞ্জিকা মতে ১৬
 এপ্রিল সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয় রাখাইন বর্ষ এবং ১৭ এপ্রিল থেকে
শুরু হয় তাদের নতুন বর্ষ। তাই অনেক অঞ্চলে এদের এ উৎসবটি হয় সাধারণত ১৭
থেকে ১৯ এপ্রিল। তবে কক্সবাজারে বসবাসরত রাখাইনরা বছর শেষ হবার তিন দিন আগ
থেকে সাত দিন ধরে এ উৎসব পালন করে থাকে। ‘সাংগ্রেং’ এর শাব্দিক অর্থ
‘সংক্রান্তি’। এ উৎসবটির সময় দূর প্রবাসে থাকা রাখাইনরাও নিজ নিজ গ্রামে
ফিরে আসেন তাদের আপনজনদের কাছে। উৎসবের জন্য ঘর-দোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা
 হয় এবং পরিবারের সবার জন্য কেনা হয় নতুন পোশাক। এ সময় ঘরে ঘরে পিঠাপুলি
বানানোর ধুম পড়ে যায়। উৎসবের প্রথম দিনে প্রত্যেক পাড়া থেকে বৌদ্ধবিহার বা ক্যাংয়ের উদ্দেশে
ধর্মীয় শোভাযাত্রা বের হয়। নতুন কাপড় পরে সবাই এতে অংশ নেয়। অগ্রভাগে থাকেন
 ঘণ্টাবাদক। তিনি ‘ছেংগ্যে’ নামক বিশেষ ধরনের ঘন্টা বাজিয়ে শোভাযাত্রাকে
গন্তব্যে নিয়ে চলেন। অতঃপর যুবকরা পানিভর্তি কলসি কাঁধে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে
এগোতে থাকে। এ সময় সবাই দানসামগ্রী সঙ্গে রাখে। দানসামগ্রীর মধ্যে থাকে—
কল্পতরু, চাউল, গুড় বা চিনি, দুধ, কলা, নারকেল, মোমবাতি, দেয়াশলাই ইত্যাদি।
 সবশেষে থাকে বাদক দল। শোভাযাত্রাটি নির্দিষ্ট ক্যাং বা বৌদ্ধবিহারে গিয়ে
থামে। বুদ্ধমূর্তিসমূহকে সুগন্ধি মিশ্রিত পানির সাহায্যে ধৌত ও পরিচ্ছন্ন
করা হয়। এ জন্য বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের পৌরহিত্যে ত্রিরতœ-বন্দনা, শীল গ্রহণ ও
উৎসর্গ এর মতো আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। এই প্রার্থনা সভায় নারী-পুরুষ
সবাই অংশ নেন। এ দিনের এই উৎসবকে রাখাইন ভাষায় বলে ‘ফারা রিসো পোয়ে’ অর্থাৎ
 বুদ্ধ œান উৎসব। অতঃপর দুই দিন সবাই মেতে থাকেন শীল গ্রহণ, উপবাস ব্রত
পালন, দান-দক্ষিণা এবং আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের মাঝে মিষ্টান্ন
বিতরণে। এরপর
 আসে ‘আচাটক’ দিন। একে সত্যিকার অর্থে সাংগ্রেং দিন বলে। এ দিনেই নতুন
বছরের আগ্রমণ ঘটে। দিনের শুরুতেই রাখাইনরা নতুন কাপড় পড়ে প্রার্থনা ও পূজায়
 অর্ঘ্য নিবেদন এবং মিষ্টি বিতরণ করেন। ওই দিন প্রয়াতদের উদ্দেশে পি-দান
এবং ক্যাং বা বৌদ্ধবিহারে ফুল, মোম ও অর্ঘ্য সামগ্রী নিয়ে তাদের আত্মার
শান্তি কামনা করা হয়। এর পরদিন থেকে শুরু হয় রাখাইনদের তিন দিনব্যাপী ‘রিলং
 পোয়ে’ বা জলকেলি বা পানি উৎসব। জলকেলিকে অনেকেই জল সিঞ্চন উৎসবও বলে থাকে। এ উৎসব উপলক্ষে প্রতি পাড়ায়
ফুল, বেলুন, অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে মণ্ডপ বা প্যাণ্ডেল তৈরি করা হয়।
প্রত্যেক মণ্ডপের তত্ত্বাবধানে থাকে মেয়েদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি।
মণ্ডপের একদিকে ড্রাম বা নৌকায় পানিভর্তি করে রাখা হয়। তার পাশেই পানির
পাত্র হাতে একই রকম কাপড়ে সেজে রাখাইন তরুণীরা দাঁড়িয়ে থাকে। অন্যদিকে
রাখাইন তরুণরা ঐতিহ্যবাহী পোশাকে বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয়ে দলবদ্ধভাবে বাদক
দলসহকারে নৃত্য-গান পরিবেশন করতে করতে মণ্ডপে প্রবেশ করে। অতঃপর তারা
দাঁড়িয়ে থাকা তরুণীদের দিকে বিশেষ নিয়ম মেনে পানি ছোড়ে। প্রত্যুত্তরে তারাও
 তরুণদের দিকে পানি ছিটাতে থাকে। পাশাপাশি চলে হাসি-ঠাট্টা-কৌতুক ও
রং-তামাশা এবং গান-বাজনা। কখনো কখনো এ সময় একে অপরকে ভালবাসাও নিবেদন করে।
এর মাধ্যমে তরুণ-তরুণীরা তাদের পছন্দের জুটিকে বেছে নিয়ে জল ছিটিয়ে আনন্দ
উৎসবে মেতে ওঠে। সত্যিকার অর্থে বর্ষবরণে আনন্দময় জলকেলি উৎসব হচ্ছে
মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা, সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের সেতুবন্ধনকে আর
সুদৃঢ় করা। জলকেলি উৎসবের উপভোগ্য বিষয় হচ্ছে ‘ছেংগ্যেই’ নামে বন্দনা জাতীয় বিশেষ
লোকগান। যার বিষয়বস্তু হলো রাখাইন সমাজের অনিয়ম অনাচার চিহ্নিত করে তা নতুন
 বছরের আগমনে শোধরানোর জন্য বলা এবং নতুন বছর যেন সুখ-সমৃদ্ধি বয়ে আনে ও
আনন্দমুখ হয় তারই বন্দনা গাওয়া। এবার বলছি মারমাদের কথা। মারমা বর্ষপঞ্জি অনুসারে মারমা সাল গণনাকে বলা
হয় গঃ জাঃ সাকুরাই। ‘তাইংখুং’ মারমা পঞ্জিকা বছরের প্রথম মাস। এ মাসেই
উদযাপিত হয় নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠান ‘সাংগ্রাইং’। এটি মারমাদের অন্যতম প্রধান
সামাজিক উৎসব। মারমারা তাৎপর্যপূর্ণ ও আনন্দের সঙ্গে সাধারণত তিন দিন
সাংগ্রাইং উৎসবের অনুষ্ঠানমালা পালন করে। প্রথম দিনটিকে এরা বলে ‘পাইং ছোয়াইক’। এর শাব্দিক অর্থ ‘ফুল তোলা’। এ
দিন মারমা যুবতীরা গোলাপ, জবা, গন্ধরাজ, বেলীসহ নানা ধরনের পাহাড়ি সুগন্ধি
ফুল সংগ্রহ করে। বুদ্ধ পূজার রাত্রে সেসব ফুল সাজিয়ে দলবেঁধে ওই দিন
ভোরবেলা সবাই বৌদ্ধবিহারে গমন করে। বুদ্ধমূর্তির বেদিতে ভক্তিসহকারে সেই
ফুল রেখে তারা প্রার্থনা নিবেদন করে এবং নানা রংয়ের মোম ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে
 রাখে। যারা বিহারে যেতে না পারে তারাও নিজ গৃহে রাখা বুদ্ধমূর্তির সামনে
ফুলের অর্ঘ্য, মোম ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে প্রণাম ও প্রার্থনা করে। উৎসবের আগেই
 বেদির স্থানটুকু ফুল ও মাল্যে ভরিয়ে দেওয়া হয়। ওই দিন ভোরে প্রবীণেরা
অষ্টশীল গ্রহণ ও উপবাস পালনের জন্য বিছানাপত্রসহ অবস্থান নেয়। বিকেলে
মন্দিরের বুদ্ধমূর্তি নিয়ে সকল বয়সী মারমারা সারিবদ্ধভাবে গ্রাম প্রদক্ষিণ
করে। যারা প্রদক্ষিণরত মিছিলে আসতে পারে না তারাও ওই সময় কলসভর্তি পানি
দিয়ে যেকোনো পথ ধুয়ে, পরিষ্কার করে বুদ্ধমূর্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন
করে। ওই রাতে মারমা যুবক-যুবতীরা গান-বাজনায় ব্যস্ত থাকে। এ সময় তারা নানা
পদের ও হরেক রকমের পিঠা-পায়েস তৈরি করে। উৎসবের দ্বিতীয় দিনটিকে মারমারা বলে ‘সাংগ্রাইং রাইকু বা আইক্যা’।
এ  দিনটি সাংগ্রাইং দেবীর আগমন দিবস। তাই ভোর থেকে রাত অবধি মারমারা নানা আচার
 পালন করে। ঘরে ঘরে চলে প্রবীণ পূজা। আগত পূজারীকে প্রবীণ গুরুজন কর্তৃক
প্রদান করা হয় আশীর্বচন। পূজার্ঘ্যর জন্য কলা, পেঁপে, নারকেল ইত্যাদি রঙিন
কাগজে মুড়ে মোমবাতির প্যাকেটসহ তা বুদ্ধ মূর্তির বেদিতে রেখে প্রার্থনা করা
 হয়।‘সাংগ্রাইং আপ্যাইন’ হচ্ছে উৎসবের তৃতীয় দিন। এটা দেবীর নির্গমন দিবস।
তাই ভোরে মঙ্গলাচরণ ও স্তত্র পাঠ, সকালে অষ্টশীল গ্রহণ ও পিণ্ডদান, বিকেলে
গোলাপ ও চন্দন মিশ্রিত জলে বুদ্ধ �œান, সন্ধ্যায় প্রদীপ পূজা এবং রাতের
আরতি দানের মধ্য দিয়ে দিবসের সমাপ্তি ঘটে।মারমা সমাজে সাংগ্রাইং উৎসবের উল্লেখিত তিন দিনের অনুষ্ঠান ছাড়াও সামাজিকভাবে রিলংবোয়ে বা জলকেলি অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। মারমা যুবক-যুবতীদের মধ্যে এ অনুষ্ঠান সামাজিক ঐক্য, সম্প্রীতি,  প্রেম-ভালোবাসায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এ অনুষ্ঠানে যুবতীরা প্যান্ডেলের
 ভিতরে পানিভর্তি নৌকা বা ড্রামকে পেছনে রেখে সারিবদ্ধভাবে পানির পাত্র
হাতে নিয়ে নৌকা বা ড্রামের গা ঘেঁষে বসে থাকে। যুবকেরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে
নেচে গেয়ে প্যান্ডেলের দিকে এগোতে থাকে। প্রত্যেকের হাতে থাকে খালি বালতি ও
 মগ। তারা কমিটির কাছ থেকে নির্ধারিতহারে পানি কিনে প্যান্ডেলের বাইরে পানি
 নিক্ষেপ স্থানে অবস্থান নেয়। যুবতীরা যুবকদের দিকে পিঠ রেখে উল্টোদিকে
ফিরে সারিবদ্ধভাবে নৌকার পাশে বসে কিংবা ড্রামের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রতিটি যুবক পছন্দানুযায়ী এক একজন যুবতীকে লক্ষ্য করে নির্দিষ্ট স্থান
থেকে পিঠের ওপর পানি নিক্ষেপ করে। দুই তিনবার পানি পড়ার পর যুবতীটি উঠে
ঘুরে দাঁড়িয়ে যুবকের মুখোমুখি হয়ে নৌকা বা ড্রাম থেকে মগে পানি তুলে যুবকের
 মুখের দিকে প্রীতি বিনিময়সূচক পানি ছুঁড়ে মারে। যুবকের বালতির পানি শেষ না
 হওয়া পর্যন্ত উভয়ে পরস্পরের প্রতি এভাবে পানি ছুড়তে থাকে। পানি নিক্ষেপে
কোনো ঝগড়া বিবাদ করা যায় না। কৌনিক বা আড়াআড়িভাবে পানি নিক্ষেপ নিষেধ থাকে।
 অনুষ্ঠান চলাকালে কেউ কোন অশোভন, অশালীন বা অশ্লীল আচরণও করতে পারে না। মারমারা মনে করে, সংক্রান্তি শব্দ থেকেই এসেছে ‘সাংগ্রাইং’ শব্দটি। তাই
চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সাংগ্রাইং উৎসব পালন করা হয়। তাদের বিশ্বাস, এ
পৃথিবীতে সাংগ্রাং নামে এক ধর্মীয় দেবী মানুষের সৌভাগ্য আর কল্যাণ বয়ে নিয়ে
 আসেন। স্বর্গ থেকে মর্ত্যে দেবী নেমে আসার অর্থাৎ পৃথিবীতে পা রাখার
ক্ষণটি থেকেই শুরু হয় সাংগ্রাইং বা নববর্ষ পালনের উৎসব। পৃথিবীতে যে কয়েক
দিন দেবী অবস্থান করবেন সে কয়েক দিন ধরেই চলে সাংগ্রাইং উৎসব। যুগে যুগে
আদিবাসীদের এমন আদি বিশ্বাসগুলোই টিকিয়ে রেখেছে আদিবাসীদের বর্ণাঢ্য
উৎসবগুলোকে।
লেখক : সালেক খোকন, প্রাবন্ধিক ও গবেষক, ছবি : লেখক

0 Comment "আদিবাসী উৎসব : সাংগ্রেং ও সাংগ্রাইং "

Post a Comment