ভূমি কমিশনের মাধ্যমে সমতলের আদিবাসীদের সংকট সুরাহার দাবি

৯ আগস্ট শুক্রবার বিশ্ব আদিবাসী দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য: ‘আদিবাসী জাতিসমূহের অধিকারসংক্রান্ত সব চুক্তি ও অঙ্গীকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন’।
নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে শুক্রবার সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হবে। কিন্তু কাজ কতটা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, বিশ্বজুড়ে আদিবাসীদের ভূমিসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান বছরের পর বছরেও হয়নি।
মৌলভীবাজারের আদিবাসী খাসি (খাসিয়া) জনগোষ্ঠীর ভূমি সমস্যাও দীর্ঘদিনের। বংশপরম্পরায় জমিতে বসবাস ও পানের চাষ করলেও ভূমির ওপর তাঁদের অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ জীবনমানের উন্নয়ন ঘটছে না বলে মনে করছেন আদিবাসী নেতারা। তাই ভূমি কমিশনের মাধ্যমে সমতলের আদিবাসীদের প্রকৃত ভূমির মালিকানা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। আদিবাসী নেতারা জানান, মৌলভীবাজারের ছয়টি উপজেলায় ছোট-বড় ৭৮টি পানপুঞ্জি রয়েছে। এর বাইরে সিলেটের জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাট; হবিগঞ্জের চুনারুঘাট ও বাহুবল এবং সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে খাসিয়াদের পানপুঞ্জি রয়েছে। এর মধ্যে সিলেটে ১৩টি, সুনামগঞ্জে একটি ও হবিগঞ্জে দুটি পানপুঞ্জি আছে। এসব পানপুঞ্জিতে প্রায় ১০ হাজার আদিবাসী খাসি ও গারো সম্প্রদায়ের লোক বাস করছেন।
বেসরকারি সংস্থা শেডের (সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট) একটি প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ৮৯ দশমিক ২৯ শতাংশ খাসিয়া পান চাষের মাধ্যমে জীবন যাপন করেন। তাঁদের উৎপাদিত পানের নাম ‘খাসিয়া পান’। খাসিয়ারা ঐতিহ্যগত ও উত্তরাধিকার সূত্রে বনভূমির বাসিন্দা। খাসি অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে পান চাষ। কিন্তু অনেক দিন ধরে এই আদিবাসী জনগোষ্ঠী ভূমি সমস্যায় রয়েছে। প্রায়ই পানপুঞ্জির ভূমি নিয়ে বন বিভাগ ও চা-বাগানের মধ্যে সংঘাতময় পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। সরল আদিবাসীরা নানা হয়রানিমূলক মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ভূমির নিয়মকানুন না জানার কারণে অনেক পানপুঞ্জির মন্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) ভূমির দলিলপত্র সংগ্রহ করেননি। ফলে অনেক জমি তাঁদের হাতছাড়া হয়েছে।
আদিবাসী খাসিরা বলছেন, তাঁরা হচ্ছেন প্রকৃতির সন্তান। বনই তাঁদের জীবন ও জীবিকার উৎস। সেই বনে তাঁরা ভূমির নিশ্চিত মালিকানা নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে পারছেন না। ভূমির মালিকানা নিশ্চিত না হওয়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ জীবনমানের উন্নয়ন হচ্ছে না। তা ছাড়া পানপুঞ্জি এলাকায় কোনো চিকিৎসাসুবিধা নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও পুঞ্জি থেকে অনেক দূরে দূরে।
আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য গঠিত সংগঠন কুবরাজ (মৌলভীবাজারের চার উপজেলা কুলাউড়া, বড়লেখা, রাজনগর ও জুড়ীর আদ্যক্ষর নিয়ে নামকরণ) সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় স্থানীয় প্রশাসন পানপুঞ্জির আদিবাসীদের ভূমি সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আদিবাসী নেতারা দাবি করেছেন, এসব উদ্যোগের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের ঐতিহ্য, প্রথা, সংস্কৃতি ও জীবিকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাই এসব উদ্যোগে আদিবাসীরা সাড়া দিতে পারেননি। এতে বছরের পর বছর ধরে ভূমির অধিকারের দাবি নিয়ে তাঁদের সোচ্চার থাকতে হচ্ছে।
কুলাউড়া উপজেলার মেঘাটিলা পানপুঞ্জির মন্ত্রী ও আদিবাসী নারী উন্নয়ন ফেডারেশনের সভানেত্রী মনিকা খংলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বংশপরম্পরায় পানপুঞ্জিতে বসবাস করে আসছি। সব সরকারের কাছেই ভূমি অধিকারের দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু আমাদের দাবিগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।’
আদিবাসী নেতারা জানান, ২০১২ সালে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরকারি খাসজমির অবৈধ দখল রোধে খাসিয়া পরিবারপ্রতি এক একর করে খাসজমি বিশেষ বিবেচনায় বন্দোবস্ত দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু আদিবাসীরা এই প্রস্তাবে সাড়া দেননি। কারণ, একটি ছোট জুম করতে চাইলেও তিন একর জমির দরকার হয়।
আদিবাসীদের নিয়ে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইপিডিএসের (ইনডিজিনাস পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস) কুলাউড়া কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অরিজেন খংলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশনের দাবি ছিল। সীমানা নির্ধারণ না থাকায় আদিবাসীদের বসবাসের ভূমিও অনেক সময় ইজারা দেওয়া হচ্ছে। আদিবাসীদের ভূমির মালিকানা দাবি করছে বন বিভাগ, চা-বাগান। স্থানীয় প্রভাবশালীরা আদিবাসীদের জায়গা দখল করার চেষ্টা করেন। প্রভাবশালীদের হাতি, গরু-মহিষ পানজুমে ঢুকে পানের ক্ষতি করছে।’ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও কুবরাজের সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলী তালাং সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমাদের মনে হয়েছে, প্রশাসনিক লোকজন আদিবাসীদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুধাবন করতে পারেন না। আদিবাসীদের বন, পণ, সম্পদ, ঐতিহ্যগত প্রথা সংরক্ষণ করতে ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা দরকার। বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যাগুলোর জট খোলার সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। তাই সমতলের আদিবাসীরা সব সময় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকেন।’ ফ্লোরা বাবলী তালাং আরও বলেন, এই সমস্যার সমাধান স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয়। এর জন্য উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত দরকার।

0 Comment "ভূমি কমিশনের মাধ্যমে সমতলের আদিবাসীদের সংকট সুরাহার দাবি"

Post a Comment